তারা আরও বলছেন, দেশের প্রচলিত নির্বাচন ব্যবস্থায় ভোটের সময় প্রিসাইডিং বা পোলিং কর্মকর্তাদের অনিয়ম, ব্যালট পেপার ছিনতাই, ভোট বাক্স ভর্তি করা ও রাজনৈতিক দলের ক্যাডারদের ভোটকেন্দ্র দখলের মতো দীর্ঘদিনের সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে ইভিএম এক উপযুক্ত বিকল্প।
ইউএনবির সাথে আলাপকালে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন, স্থানীয় সরকার ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ, সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সভাপতি এম হাফিজউদ্দিন খান এবং জানিপপের চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, ইভিএম ব্যবহার নিয়ে ভয় দূর করতে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) অবিলম্বে রাজনৈতিক দল ও সব অংশীজনদের সাথে আলোচনায় বসে তাদের প্রশ্নের উত্তর দেয়া উচিত।
ব্যালট পেপারের পরিবর্তে ইভিএম ব্যবহার করে আগামী ৩০ জানুয়ারি ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ভোটগ্রহণের যন্ত্রগুলোর সুরক্ষার জন্য প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে দুজন সেনা সদস্য উপস্থিত থাকবেন।
তবে বিএনপি ইসিকে ইভিএম ব্যবহারের পরিকল্পনা বাদ দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে। দলটি মনে করে যে জনগণের ভোটাধিকার নস্যাৎ করে দেয়ার জন্য ইভিএম ‘সরকারের এক অশুভ-উদ্দেশ্যমূলক প্রকল্প’।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন মনে করেন সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে ইভিএম খুব ভালো এক উদ্যোগ।
‘প্রচলিত ব্যালট পেপারে ভোটগ্রহণের ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা রয়েছে। আমরা প্রায়ই ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নেয়া, এমনকি রাতের বেলাতেও ব্যালট বাক্স ভরা ও জাল ভোট দেয়ার ঘটনা দেখি। আমরা যদি এ সমস্যাগুলো সমাধান করতে চাই তবে আমাদের অবশ্যই ভোটগ্রহণ ব্যবস্থা পরিবর্তন করে ইভিএম গ্রহণ করতে হবে,’ বলেন তিনি।
তবে সাবেক এ নির্বাচন কমিশনার জানান, ইসি কোনো পূর্ব প্রস্তুতি এবং সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সাথে আলোচনা না করেই হঠাৎ করে সিটি নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ‘নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে ইসির উচিত ছিল ভোটগ্রহণ যন্ত্রের ব্যবহার নিয়ে রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজের সদস্য ও অন্য অংশীদারদের সাথে আলোচনা করা।’
তার মতে, যেহেতু ইভিএম নিয়ে জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কিছুটা উদ্বেগ ও বিভ্রান্তি রয়েছে তাই ইসির উচিত সংলাপ ও প্রচারণার মাধ্যমে এগুলো দূর করার জন্য পদক্ষেপ নেয়া।
‘যেহেতু যেকোনো নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো প্রধান অংশীজন, তাই প্রথমে তাদের ভোটগ্রহণ যন্ত্র সম্পর্কে ভীতি ও ভুল ধারণা দূর করার মাধ্যমে বুঝ দিতে হবে কমিশনকে। আমি মনে করি, কমিশনের এটি করার এখনও সময় আছে,’ যোগ করেন সাখাওয়াত হোসেন।
তিনি বলেন, ইভিএমের মাধ্যমে নির্বাচনে কারসাজি করা খুব কঠিন কাজ। কারণ এ জন্য ইভিএম পরিচালনায় জড়িত পুরো টিমকে রাজি করাতে হবে। ‘কিন্তু আমাদের সেনাবাহিনীর কর্মীরা সাধারণত ইভিএম নিয়ে কাজ এবং এর সুরক্ষা নিশ্চিত করেন। সুতরাং, আমরা তাদের বিশ্বাস করতে পারি।’
সাখাওয়াত হোসেন আরও বলেন, এ যন্ত্রগুলো একে অপরের সাথে বা কেন্দ্রীয় সার্ভারের সাথে সংযুক্ত না থাকায় দূর থেকে ভোট জালিয়াতি বা হ্যাক হওয়ার কোনো ঝুঁকি নেই। ‘সুতরাং, আমি মনে করি ইভিএম ব্যালট পেপারের চেয়ে ভালো ব্যবস্থা এবং আমাদের এটি গ্রহণ করা উচিত। তবে এর অপব্যবহার সম্পর্কে মানুষের মাঝে যে উদ্বেগ তা নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই নিরসন করতে হবে।’
ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, যদি যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হয় এবং ভোটগ্রহণ যন্ত্র পরিচালনায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা নিরপেক্ষ ও পেশাদারীত্বের সাথে দায়িত্ব পালন করেন তাহলে এগুলো সুষ্ঠু ভোট নিশ্চিত করতে সহায়ক হতে পারে।
‘প্রথমত, আমি মনে করি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত নির্বাচনী পরিবেশ প্রয়োজন। যদি উপযুক্ত নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি না হয়, তবে ইভিএম বা ব্যালট যা-ই আমরা ব্যবহার করি না কেন, ভোটগ্রহণ সুষ্ঠু হওয়ার সম্ভাবনা কম,’ বলেন তিনি।
সাখাওয়াত হোসেনের কথার প্রতিধ্বনি করে ড. তোফায়েল বলেন, ইভিএম সম্পর্কে রাজনৈতিক দল এবং অংশীজনদের বিভ্রান্তি ও ভয় দূর করার জন্য ইসির উচিত তাদের সাথে আলোচনা করা। ‘ভোটগ্রহণ যন্ত্র সম্পর্কে বিভিন্ন দল ও বিশেষজ্ঞদের উত্থাপিত নানা প্রশ্নের উপযুক্ত উত্তর নিয়ে আসতে হবে কমিশনকে।’
তিনি বলেন, ভোটাররা যাতে ভোট দিতে নির্দ্বিধায় ভোটকেন্দ্রে যেতে পারেন সে জন্য তাদের মন থেকে আশঙ্কা দূর করে অনুকূল নির্বাচনী পরিবেশ তৈরির জন্যও পদক্ষেপ নেয়া উচিত ইসির।
এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার নিয়ে শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বজুড়ে মানুষজন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে প্রশ্ন ও সন্দেহ রয়েছে। ‘প্রযুক্তি ভীতির কারণে ভোটাররা এখনো ইভিএম নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। সুতরাং, আমি মনে করি যদি না সব রাজনৈতিক দল এতে রাজি হয় তাহলে নির্বাচন কমিশন ভোটগ্রহণ যন্ত্রগুলো সীমিত আকারে ব্যবহার করতে পারে।’
‘আমি মনে করি, নির্বাচন কমিশনের উচিত ভোটগ্রহণের জন্য পুরোদমে ইভিএম ব্যবস্থা ব্যবহারের আগে প্রথমে এ সম্পর্কে জনগণের আস্থা অর্জন করা। এ জাতীয় যন্ত্রের ব্যবহার সম্পর্কে মানুষের ভীতি দূর করার জন্যও তাদের পদক্ষেপ নেয়া উচিত,’ যোগ করেন তিনি।
নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, কিছু রাজনৈতিক দলের ইভিএম সম্পর্কে ভুল ধারণা রয়েছে, যদিও এটি শতভাগ নিরাপদ নির্বাচনী ব্যবস্থা।
‘আমাদের নির্বাচন কমিশন সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ইভিএমের সর্বশেষ সংস্করণ ব্যবহার করছে। আমি নিজে ইভিএম পরীক্ষা করে দেখেছি যে সেগুলো শতভাগ নিরাপদ। যারা এর বিরোধিতা করছেন তারা অনুমানের ভিত্তিতে কারসাজি নিয়ে কিছু কথা বলছেন,’ যোগ করেন তিনি।
তিনি বলেন, বিশ্বাসযোগ্য ভোটের জন্য ইভিএম যে নিরাপদ তা রাজনৈতিক দলগুলোকে বোঝানোর দায়িত্ব ইসির। ‘ভোটগ্রহণ যন্ত্র সম্পর্কে জনগণের ভুল ধারণা দূর করতে গণ প্রচারণা, প্রতীকী ভোটদান এবং সেমিনার ও আলোচনার আয়োজন করা প্রয়োজন।’